লন্ডন ০২:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দিরাই সরকারি হাসপাতাল: কাগজে ৫০ শয্যা হলেও বাস্তবে সেবাশূন্য

সুনামগঞ্জ জেলার হাওরবেষ্টিত দিরাই উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষের একমাত্র সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান দিরাই সরকারি হাসপাতাল। সরকারি নথিতে এটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।চিকিৎসক ও নার্সের অভাব, জরুরি যন্ত্রপাতির অচলাবস্থা, ওষুধের অপ্রতুলতা এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সব মিলিয়ে এই হাসপাতাল বর্তমানে কার্যত সেবাশূন্য অবস্থায় রয়েছে।

সরকারি বিধি অনুযায়ী, একটি ৫০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে ১৫-২০ জন এমবিবিএস চিকিৎসক ও ২০ থেকে ২৫ জন নার্স থাকার কথা। অথচ দিরাই হাসপাতালে বর্তমানে মাত্র ৫ জন চিকিৎসক ১ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ১১ জন নার্স কর্মরত রয়েছেন।চিকিৎসক যারা রয়েছেন তারাও ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট চেম্বার নিয়ে। প্রতিদিন শত শত রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

জরুরি বিভাগেও চিকিৎসক প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন। অনেক সময় চিকিৎসক না থাকার ফলে প্রশিক্ষণাধীন ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরাই ইন্টার্নশিপ ছাড়াই রোগী দেখছেন ও প্রেসক্রিপশন লিখছেন। এতে রোগ নির্ণয়ে ভুল, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ভোগান্তির মাত্রা বাড়ছে।

অপর্যাপ্ত জনবল ও পরিকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সাধারণ ইনফেকশনসহ ছোটখাটো সমস্যাতেও অনেক রোগীকে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়। হাওরের দরিদ্র মানুষের পক্ষে এই দীর্ঘ যাত্রা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি কষ্টসাধ্য। ফলে অনেকেই চিকিৎসা না নিয়েই বাড়ি ফিরতে বাধ্য হন।

হাসপাতালের যন্ত্রপাতি গুলোর অবস্থাও করুণ। এক্সরে মেশিন প্রায় দুই দশক ধরে অচল। আধুনিক প্যাথলজি যন্ত্র থাকলেও তা চালু হয়নি। বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর থাকলেও সচল করা হয় না, ফলে গরমে ভর্তি রোগীদের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। সরকারি ওষুধের তালিকায় থাকলেও বাস্তবে রোগীরা পাচ্ছেন হাতে গোনা কিছু সাধারণ ওষুধ। অধিকাংশ ওষুধই কিনে আনতে হয় বাইরের দোকান থেকে। ভর্তি থাকা এক রোগীর অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি হাসপাতালে এসে যদি সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়, তাহলে এতো ভরসা করে এখানে আসার মানে কী।

২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দিরাই হাসপাতালে তিনতলা বিশিষ্ট একটি নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন। একইসাথে হাসপাতালকে ৩০ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত সেই ভবন আজও রোগীসেবায় ব্যবহার হয়নি। প্রয়োজনীয় আসবাব, জনবল ও কার্যক্রম না থাকায় ভবনটি প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফলে রোগীরা এখনও পুরনো ভবনের গাদাগাদি পরিবেশে চিকিৎসাসেবা নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

আইসিইউ সুবিধাসম্পন্ন একটি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স চালক না থাকায় একদিনের জন্যও চালু হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার না হওয়ায় এটি হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থেকেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

হাসপাতালের পরিবেশও রোগীবান্ধব নয়। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না থাকায় ওয়ার্ড ও বাথরুমে ময়লা-আবর্জনা জমে থাকে। ভর্তি হওয়া এক রোগী বলেন, ওয়ার্ডে ঠিকভাবে পরিস্কার করা হয় না। বাথরুমগুলো এত নোংরা যে ভেতরে যাওয়া যায় না। মনে হয় হাসপাতালে এসে আরেকটা নতুন রোগ নিয়ে বাড়ি ফিরবো।

সব মিলিয়ে দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখন কেবল নামেই একটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল। স্থানীয়দের দাবি, দ্রুত প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, যন্ত্রপাতি সচলকরণ ও সেবার মান উন্নয়নে সরকারি হস্তক্ষেপ না হলে হাওরাঞ্চলের মানুষ চিকিৎসাবঞ্চিতই থেকে যাবে।

এই সার্বিক দুরবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শংকর চন্দ্র দাস বলেন, হাসপাতালে লোকবল সংকট প্রকট। আমরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লোকবল বৃদ্ধির জন্য চিঠি দিয়ে আসছি। আশা করি, জনবল বাড়ানো হলে চিকিৎসাসেবা উন্নত হবে এবং রোগীদের দুর্ভোগ অনেকটাই কমবে।

ট্যাগ:

সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল লতিফ জেপির ইন্তেকাল

দিরাই সরকারি হাসপাতাল: কাগজে ৫০ শয্যা হলেও বাস্তবে সেবাশূন্য

প্রকাশের সময়: ০৮:৩৯:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ অগাস্ট ২০২৫

সুনামগঞ্জ জেলার হাওরবেষ্টিত দিরাই উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষের একমাত্র সরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান দিরাই সরকারি হাসপাতাল। সরকারি নথিতে এটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।চিকিৎসক ও নার্সের অভাব, জরুরি যন্ত্রপাতির অচলাবস্থা, ওষুধের অপ্রতুলতা এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সব মিলিয়ে এই হাসপাতাল বর্তমানে কার্যত সেবাশূন্য অবস্থায় রয়েছে।

সরকারি বিধি অনুযায়ী, একটি ৫০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে ১৫-২০ জন এমবিবিএস চিকিৎসক ও ২০ থেকে ২৫ জন নার্স থাকার কথা। অথচ দিরাই হাসপাতালে বর্তমানে মাত্র ৫ জন চিকিৎসক ১ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ১১ জন নার্স কর্মরত রয়েছেন।চিকিৎসক যারা রয়েছেন তারাও ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট চেম্বার নিয়ে। প্রতিদিন শত শত রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

জরুরি বিভাগেও চিকিৎসক প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন। অনেক সময় চিকিৎসক না থাকার ফলে প্রশিক্ষণাধীন ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরাই ইন্টার্নশিপ ছাড়াই রোগী দেখছেন ও প্রেসক্রিপশন লিখছেন। এতে রোগ নির্ণয়ে ভুল, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ভোগান্তির মাত্রা বাড়ছে।

অপর্যাপ্ত জনবল ও পরিকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সাধারণ ইনফেকশনসহ ছোটখাটো সমস্যাতেও অনেক রোগীকে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়। হাওরের দরিদ্র মানুষের পক্ষে এই দীর্ঘ যাত্রা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি কষ্টসাধ্য। ফলে অনেকেই চিকিৎসা না নিয়েই বাড়ি ফিরতে বাধ্য হন।

হাসপাতালের যন্ত্রপাতি গুলোর অবস্থাও করুণ। এক্সরে মেশিন প্রায় দুই দশক ধরে অচল। আধুনিক প্যাথলজি যন্ত্র থাকলেও তা চালু হয়নি। বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর থাকলেও সচল করা হয় না, ফলে গরমে ভর্তি রোগীদের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। সরকারি ওষুধের তালিকায় থাকলেও বাস্তবে রোগীরা পাচ্ছেন হাতে গোনা কিছু সাধারণ ওষুধ। অধিকাংশ ওষুধই কিনে আনতে হয় বাইরের দোকান থেকে। ভর্তি থাকা এক রোগীর অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি হাসপাতালে এসে যদি সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হয়, তাহলে এতো ভরসা করে এখানে আসার মানে কী।

২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দিরাই হাসপাতালে তিনতলা বিশিষ্ট একটি নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন। একইসাথে হাসপাতালকে ৩০ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত সেই ভবন আজও রোগীসেবায় ব্যবহার হয়নি। প্রয়োজনীয় আসবাব, জনবল ও কার্যক্রম না থাকায় ভবনটি প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফলে রোগীরা এখনও পুরনো ভবনের গাদাগাদি পরিবেশে চিকিৎসাসেবা নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

আইসিইউ সুবিধাসম্পন্ন একটি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স চালক না থাকায় একদিনের জন্যও চালু হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার না হওয়ায় এটি হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থেকেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

হাসপাতালের পরিবেশও রোগীবান্ধব নয়। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না থাকায় ওয়ার্ড ও বাথরুমে ময়লা-আবর্জনা জমে থাকে। ভর্তি হওয়া এক রোগী বলেন, ওয়ার্ডে ঠিকভাবে পরিস্কার করা হয় না। বাথরুমগুলো এত নোংরা যে ভেতরে যাওয়া যায় না। মনে হয় হাসপাতালে এসে আরেকটা নতুন রোগ নিয়ে বাড়ি ফিরবো।

সব মিলিয়ে দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখন কেবল নামেই একটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল। স্থানীয়দের দাবি, দ্রুত প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ, যন্ত্রপাতি সচলকরণ ও সেবার মান উন্নয়নে সরকারি হস্তক্ষেপ না হলে হাওরাঞ্চলের মানুষ চিকিৎসাবঞ্চিতই থেকে যাবে।

এই সার্বিক দুরবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শংকর চন্দ্র দাস বলেন, হাসপাতালে লোকবল সংকট প্রকট। আমরা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লোকবল বৃদ্ধির জন্য চিঠি দিয়ে আসছি। আশা করি, জনবল বাড়ানো হলে চিকিৎসাসেবা উন্নত হবে এবং রোগীদের দুর্ভোগ অনেকটাই কমবে।