লন্ডন ০৮:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এমপি হয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক রতন

 

আওয়ামী লীগের বিতর্কিত ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদুক) কর্মকর্তারা। বুধবার তাহিরপুরে গিয়ে রতনের নানা চাঁদাবাজি দখলবাজির বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন এরা। মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ পৌর শহরে থাকা তাঁর বাড়িতে গিয়ে সেটির পরিমাপ করেছে দলটি। সোমবার তাঁর গ্রামের বাড়ি জেলার ধর্মপাশা উপজেলার নওধার গ্রামে গিয়েছিলেন দুদক কর্মকর্তারা।

সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী আসনটি জেলার ধর্মপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও মধ্যনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলরাই বিভিন্ন সময় বলেছেন, দুই কোটি টাকা খরচ করে এই আসনে দলীয় মনোনয়ন এনেছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। সামান্য বেতনে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরি করতেন তিনি। প্রথম নির্বাচন করার সময় বিভিন্ন জনের কাছ থেকে স্বাক্ষর দেওয়া চেক দিয়ে নির্বাচনী খরচের টাকা’র ব্যবস্থা করেছিলেন রতন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হয়ে টাকার মেশিন পেয়েছিলেন তিনি। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাবেক এই এমপির নানা অনিয়মের কাহিনী মুখে মুখে ঘুরছে সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকায়। দুদকের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী এমপিদের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। সিলেট বিভাগের দুর্নীতিবাজ এমপিদের মধ্যে রতনের নামও রয়েছে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও লুটপাটের মাধ্যমে নামে-বেনামে সম্পদ বানিয়েছেন রতন। সরকারি ভূমি, নিরীহ লোকজনের জমি দখল করে নিজের নামে প্রতিষ্ঠান ও আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজের ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য ৪৭ টি কার্যালয় নির্মাণ করেছিলেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। রতনের সেই দখল হওয়া জমি ফেরৎ পেতে সক্রিয় হয়েছেন বিক্ষুব্ধরা। রতনের নওধার গ্রামের আলীসান বাড়ি ‘হাওর বাংলা’র চার দেওয়ালের ভেতরে ঢুকানো ৩০ শতক জমি এবং ইটভাটা’র জন্য নেওয়া দুই একর পাঁচ শতক জমি ফেরৎ না পেলে শীঘ্রই আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার কথা জানিয়েছেন জমির মালিক বিকাশ রঞ্জন সরকার।
বিকাশ বললেন, পাশের গ্রামের বাসিন্দা এবং আগে থেকে পরিচিত হওয়ায় ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবার পর তিনিসহ প্রতিবেশি কয়েকজনকে তার বাড়িতে ডাকেন রতন।

ওই সময়ে তিনি বলেন, তার কাছে কোন টাকা নেই, কিছু চেক দিয়ে বলেন, ওই চেক দিয়ে টাকা ধার এনে দেবার জন্য। সুনই গ্রামের দুইজনের কাছ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা জামিনদার থেকে নিয়ে দিয়েছি তাঁকে। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের সঙ্গেও ভালো আচরণ করেন নি রতন। আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হওয়ায় ওই মেয়াদেই আমার বাড়ি করার মত জমি তার বাড়ি’র ভেতরে ঢুকিয়ে বললেন, উপযুক্ত মূল্য আমাকে দেবেন তিনি। পাইকুরাটি মৌজায় ধানিকোণা গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় ইটভাটা করার কথা বলে দুই একর পাঁচ শতক জমি নিজের ভাই মোবারক হোসেন ও মোজাম্মেল হোসেন রুকনের নামে লিখিয়ে নেন তিনি। এই টাকা’র তাগাদা দেওয়ায় রতন আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে থাকেন। আমি ব্যাংকার (কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা) হওয়ায় আমাকে ২০১২ ইংরেজি থেকে ২০২০ ইংরেজি পর্যন্ত তিন উপজেলায় বদলি করান।

দীর্ঘদিন নিজের বাড়িতে যাওয়ার সাহস পাননি তিনি জানিয়ে বিকাশ রঞ্জন সরকার বললেন, একবার পাইকুরাটিতে পৈত্রিক জমি বিক্রয় করে বুঝিয়ে দেবার জন্য গিয়েছিলাম। এমপি ও তার ভাই মোশারফ হোসেন ওরফে হাজী মাসুদ আমাকে এসে বললো, আপনার সাহস তো কম নয়, আমাদেরকে না জানিয়ে জমি অন্যত্র বিক্রয় করেন। আমি বলেছিলাম, তোমরা তো আগের টাকাই দাও নি, তোমাদের জানালে তো আমার ক্ষতি হতো। পরে হাজী মাসুদ ও তার ছেলে, ‘শালা মালাউন’ গালি দিয়ে আমাকে মারপিঠ করে আটকে রাখে। শেষে ৯৯৯’এ ফোন দিলে পুলিশ গিয়ে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
বিকাশ রঞ্জন সরকার বললেন, এই ঘটনায় আমি থানায় মামলা করলে, এমপি রতন পিন্টু চন্দ্র দে নামের গ্রামের আরেক ছেলেকে দিয়ে আমার নামে প্রতারণার মামলা করায়। জমি বিক্রয় করার কথা বলে গ্রামের জনৈক পিন্টু দে’র কাছ থেকে আমি তিন লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছি বলে মামলায় দাবি করা হয়। গ্রামের বশির উদ্দিন নামের আরেকজনকে দিয়ে টাকা আত্মসাতের মামলা করায়। দুটি মামলাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এমপি’র প্রভাব খাটিয়ে পুলিশকে দিয়ে আমার মামলায়ও ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ানো হয়।

আমি ছাড়াও গ্রামের প্রদীপ কুমার তালুকদার টুটুলের বাড়িও দখলের চেষ্টা করেন রতন। রতনের চাচা মাফিক আলীকে দিয়ে প্রদীপ কুমার তালুকদার টুটুলকে অপদস্তও করা হয়।

ধর্মপাশা উপজেলার সেলবরস ইউনিয়নের মাটিকাটা গ্রামের বাসিন্দা মো. মতিউর রহমান বলেন, নিজের নামে করা স্কুলের খেলার মাঠের জন্য আমাদের জমি দখলে নেওয়া হয়। আমাদের পুকুর পাড়ের ও বাড়ির গাছ- কেটে নিয়েছে তার লোকজন। বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করেছে। মামলার ভয়ে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। এমপি ও তার লোকদের ভয়ে গ্রামের মানুষ এমন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে নি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। এরপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি শুরু করেন। পাশাপাশি সরকারি জমি ও এলাকার মানুষের সম্পত্তি লুটপাট করার নেশায় পায় তাকে।

বালু-পাথর উত্তোলন, কয়লা আমদানিকারক সমিতি, বিভিন্ন মার্কেট, বাজার, নানাজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করতেন তিনি। তার নামে ঢাকা, সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, নেত্রকোনা ও মোহনগঞ্জে একাধিক বাড়ি রয়েছে। শুলশান-১ এ ন্যাম ভবনে রয়েছে ফ্ল্যাট। নিজের গ্রাম ধর্মপাশায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করেছিলেন বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’। সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে জেলা পুলিশ লাইন্সের বিপরীতে কোটি টাকায় বাড়ি (‘পায়েল পিউ’) কিনেছেন তিনি। প্রবাসেও বিশেষ করে কানাডায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এমন আলোচনাও আছে তার এলাকায়। অথচ নির্বাচনী হলফনামায় অনেক কম মূল্য দেখিয়েছেন এসব বাড়ি ও এপার্টমেন্টের।

বর্তমানে তার গ্রামের বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’ ভাড়া দিয়েছেন বিদেশী কোম্পানী নরিনকো ইন্টারন্যাশনালের (এইচ, কে,জিই সোলার পাওয়ার প্লান্ট) কাছে। গেল সপ্তাহে সেখানে সংবাদ সংগ্রহে করতে গেলে বাধার মুখে পড়তে হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। গেটে মুঠোফোনে কোম্পানির প্রতিনিধি পরিচয়ে তানভির নামে একজন গণমাধ্যমকর্মীদের অপেক্ষা করতে বলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মো. ফজলুর রহিম নামে একজন এসে ভেতর ছবি তুলার সুযোগ করে দেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ফজলুর রহিম রতনের আত্মীয়। নরিনকো ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে রতনের ব্যবসায়িক যোগাযোগ রক্ষা করেন ফজলুর রহমান।

অভিযোগ রয়েছে, কেবল বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’ নয় সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করে নিজের নামে করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ। জমির প্রকৃত মালিককে উচ্ছেদ করতে সংগঠনের লোক ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানোর অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও নির্বাচনী এলাকার ৪৭ টি এলাকায় আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ডে নিরীহদের ও সরকারি জমি দখল করে অফিস করলেও ওখানে রতনের অনুসারি ব্যবসায়ী সি-িকেটের সদস্য ছাড়া অন্য আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা বসতেন না। আওয়ামী লীগের পুরোনো কর্মীরা বসতে বিব্রত হতেন, তারা সেখানে যেতেন না। পাঁচ আগস্টের পরে এসব অফিসে তালা দিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও সরকারি জমিতে করা কয়েকটি অফিস স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন।

নির্বাচনী হলফনামায়ও রতন মিথ্যা তথ্য দেন
বার বারই তিনি সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হফলনামায় দেখানো আয় থেকে পরের তিনটি হলফনামায় অনেক কম আয় দেখিয়েছেন। তবে নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামা থেকে পরের তিনটি হলফনামায় ক্রমান্বয়ে বেড়েছে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ। এরমধ্যে স্থাবর সম্পদ বেড়েছে ২ গুণ ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৩ গুণেরও উপরে। তাঁর নিজের দেখানো আয় ও স্থাবর সম্পদ বেড়ে যাবার তথ্যেও আছে গড়মিল।

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় বাৎসরিক আয় উল্লেখ করেছেন ২ কোটি, ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪৬ টাকা, ২০১৩ সালে ২৯ লাখ ৫০ হাজার ২৬৮ টাকা, ২০১৮ সালে ৩০ লাখ ২ হাজার ৬৮৫ টাকা ও ২০২৩ সালে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৪৯ হাজার ৭৩৪ টাকা।

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় স্থাবর সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ৭৩ লাখ ৪০ হাজার ২৫৮ টাকা, ২০১৩ সালে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩০২ টাকা, ২০১৮ সালে ৩ কোটি ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৮ টাকা ও ২০২৩ সালে ৩ কোটি ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ৮৯১ টাকা।

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ১ কোটি ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৪৮৯ টাকা, ২০১৩ সালে ১ কোটি ৫৪ লাখ ১৫ হাজার ৯১০ টাকা, ২০১৮ সালে ২ কোটি ২৭ হাজার ৮৪ হাজার ৮২৭ টাকা ও ২০২৩ সালে ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৯৩০ টাকা।

২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে তিন বার এমপি হলেও ২০২৩ সালে দলের মনোনয়ন পাননি এই সাবেক এমপি। পরে এই আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. রনজিত চন্দ্র সরকার।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা দখল করে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজের জন্য ৪৭ টি অফিস নির্মাণ করেছেন। নিজের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। গ্রামের বাড়ি করেছেন ক্ষমতার জোরে অন্যের জমি দখল করে। তাহিরপুরের তিন শুল্কস্টেশন ও বালুপাথর মহাল যাদুকাটায় চাঁদাবাজি করেছেন।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ছিলেন একজন সাধারণ কর্মচারী। দুর্নীতির অভিযোগে সেখান থেকে চাকরিচ্যুতও হয়েছিলেন তিনি। দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। তবে ভাগ্য বদলাতে বেশি সময় লাগেনি। সুনামগঞ্জ-১ (ধর্মপাশা-জামালগঞ্জ-তাহিরপুর) আসনে এমপি হয়েই খুলে গেছে তার ভাগ্য। এ পদটিকে আলাদিনের চেরাগের মতো ব্যবহার করেছেন তিনি। সামান্য কর্মচারী থেকে অল্পদিনেই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এমপি ও তার পরিবারের সদস্যরা।

সাবেক এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যুবলীগ নেতা বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমমের সম্পর্ক নিয়ে বছর দুয়েক আগে গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ ছাপা হয়। অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো কারবার, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রতনকে। এক পর্যায়ে তাঁর বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। শুধু তাই নয় তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

পরিবর্তিত রাজনৈতিক এসব অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন মহলের আলোচনা ওঠায় মঙ্গলবার দুপুরে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের মল্লিকপুর এলাকায় থাকা মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি ‘স্পর্শ স্পন্দন ড্রিম হাউজে’ যান দুদকের অনুসন্ধান দলের কর্মকর্তা। সঙ্গে সুনামগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীরাও ছিলেন। তাঁরা বাড়িটি পরিমাপ করেন। বাড়িটি পরিমাপ ও মোয়াজ্জেম হোসেনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) কয়েকজন সদস্যও সেখানে ছিলেন। সোমবার একইভাবে ধর্মপাশা উপজেলার নওধার গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেনের বিলাস বহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলায়’ গিয়ে সেটির পরিমাপ করা হয়।

অনুসন্ধান দলের সদস্য দুদকের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান ভুঁইয়া জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ ছিল। ৫ আগস্টের পর আরও কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের পরিচালক আবদুল মাজেদের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল তাঁর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছেন। এই দলের বাকি দুই সদস্য হলেন, দুদকের অতিরিক্ত পরিচালক গুলশান আনোয়ার ও উপসহকারী পরিচালক এলমান আহমেদ।

মাহমুদুল হাসান ভুঁইয়া জানান, এর আগেও মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগে অনুসন্ধান হয়েছে। সেগুলোর তথ্য দুদকে আছে। এখন সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনো, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় অনুসন্ধান চলছে। তাঁরা সব জায়গায় যাবেন। অনুসন্ধান শেষে দুদকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেবেন।

মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ২০০৮ সালে প্রথম নৌকা প্রতীক নিয়ে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালেও একইভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোননয় না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন।

তার দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১০ বছরে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে বহুগুণ। ওই হিসাবের বাইরে আদতে তার সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি।

সাবেক সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে (নম্বর ০১৭১৫০২০৮৩৩, ছয় জানুয়ারি বেলা দুইটা ৪৮ মিনিটে) ফোন দিলে তিনি এসব বিষয়ের উত্তর এড়িয়ে বললেন, ‘এখন কতোজনে কতো কথা বলবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। দেশেই আছি, আমরা মাঠে নামলে সবাই দৌঁড়ে পালাবে।’

তিনি বলেন, ‘যখন আপনি ভালো থাকবেন তখন খারাপ- মন্দ কাজ করলেও লোকে ভালো বলবে। আর যখন খারাপ থাকবেন, তখন ভালো কাজটাও সবাই মন্দ বলবে। আমাদের বাঙালির কালচারটাই এরকম। অফিস করেছি, দলের জন্য কাজ করেছি এটা দোষের কিছু নয়। অনেকেরই ভালো লেগেছে, অনেকের লাগে নাই। ডিসি’র খতিয়ানের অনেক জায়গা লিজ নিয়ে অফিস করা হয়েছে। এটাও দোষের কিছু নয়। এখন অফিস অন্যরা দখলে নিয়েছে, আবার যখন মাঠে আওয়ামী লীগ আসবে, সব দৌঁড়াইয়া পালাবে। এটাই বাস্তবতা। বিএনপির নেতারা আমার বিরুদ্ধে বলবেই, কিছু করার নেই। আগে কেনো তারা এসব বলে নাই। আমাদের দলের লোকও কিছু আছে। যারা এসব সমালোচনা করছে। ২০০৮ সাল থেকে সমালোচনা শুরু হয়েছে, চলছেই। এগুলো নিয়ে কথা বলার পক্ষে নই আমি। সমালোচকরা সমালোচনা করবে, আপনার কাজ আপনি করবেন। দেখবেন আপনি এগিয়ে যাবেন।

 

ট্যাগ:

লিবিয়া থেকে ফিরিয়ে আনা হলো ১৭৩ বাংলাদেশিকে

এমপি হয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক রতন

প্রকাশের সময়: ০৫:৫৯:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী ২০২৫

 

আওয়ামী লীগের বিতর্কিত ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদুক) কর্মকর্তারা। বুধবার তাহিরপুরে গিয়ে রতনের নানা চাঁদাবাজি দখলবাজির বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন এরা। মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ পৌর শহরে থাকা তাঁর বাড়িতে গিয়ে সেটির পরিমাপ করেছে দলটি। সোমবার তাঁর গ্রামের বাড়ি জেলার ধর্মপাশা উপজেলার নওধার গ্রামে গিয়েছিলেন দুদক কর্মকর্তারা।

সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী আসনটি জেলার ধর্মপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও মধ্যনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীলরাই বিভিন্ন সময় বলেছেন, দুই কোটি টাকা খরচ করে এই আসনে দলীয় মনোনয়ন এনেছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। সামান্য বেতনে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরি করতেন তিনি। প্রথম নির্বাচন করার সময় বিভিন্ন জনের কাছ থেকে স্বাক্ষর দেওয়া চেক দিয়ে নির্বাচনী খরচের টাকা’র ব্যবস্থা করেছিলেন রতন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হয়ে টাকার মেশিন পেয়েছিলেন তিনি। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাবেক এই এমপির নানা অনিয়মের কাহিনী মুখে মুখে ঘুরছে সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকায়। দুদকের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী এমপিদের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। সিলেট বিভাগের দুর্নীতিবাজ এমপিদের মধ্যে রতনের নামও রয়েছে।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও লুটপাটের মাধ্যমে নামে-বেনামে সম্পদ বানিয়েছেন রতন। সরকারি ভূমি, নিরীহ লোকজনের জমি দখল করে নিজের নামে প্রতিষ্ঠান ও আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজের ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য ৪৭ টি কার্যালয় নির্মাণ করেছিলেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। রতনের সেই দখল হওয়া জমি ফেরৎ পেতে সক্রিয় হয়েছেন বিক্ষুব্ধরা। রতনের নওধার গ্রামের আলীসান বাড়ি ‘হাওর বাংলা’র চার দেওয়ালের ভেতরে ঢুকানো ৩০ শতক জমি এবং ইটভাটা’র জন্য নেওয়া দুই একর পাঁচ শতক জমি ফেরৎ না পেলে শীঘ্রই আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার কথা জানিয়েছেন জমির মালিক বিকাশ রঞ্জন সরকার।
বিকাশ বললেন, পাশের গ্রামের বাসিন্দা এবং আগে থেকে পরিচিত হওয়ায় ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবার পর তিনিসহ প্রতিবেশি কয়েকজনকে তার বাড়িতে ডাকেন রতন।

ওই সময়ে তিনি বলেন, তার কাছে কোন টাকা নেই, কিছু চেক দিয়ে বলেন, ওই চেক দিয়ে টাকা ধার এনে দেবার জন্য। সুনই গ্রামের দুইজনের কাছ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা জামিনদার থেকে নিয়ে দিয়েছি তাঁকে। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের সঙ্গেও ভালো আচরণ করেন নি রতন। আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হওয়ায় ওই মেয়াদেই আমার বাড়ি করার মত জমি তার বাড়ি’র ভেতরে ঢুকিয়ে বললেন, উপযুক্ত মূল্য আমাকে দেবেন তিনি। পাইকুরাটি মৌজায় ধানিকোণা গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় ইটভাটা করার কথা বলে দুই একর পাঁচ শতক জমি নিজের ভাই মোবারক হোসেন ও মোজাম্মেল হোসেন রুকনের নামে লিখিয়ে নেন তিনি। এই টাকা’র তাগাদা দেওয়ায় রতন আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে থাকেন। আমি ব্যাংকার (কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা) হওয়ায় আমাকে ২০১২ ইংরেজি থেকে ২০২০ ইংরেজি পর্যন্ত তিন উপজেলায় বদলি করান।

দীর্ঘদিন নিজের বাড়িতে যাওয়ার সাহস পাননি তিনি জানিয়ে বিকাশ রঞ্জন সরকার বললেন, একবার পাইকুরাটিতে পৈত্রিক জমি বিক্রয় করে বুঝিয়ে দেবার জন্য গিয়েছিলাম। এমপি ও তার ভাই মোশারফ হোসেন ওরফে হাজী মাসুদ আমাকে এসে বললো, আপনার সাহস তো কম নয়, আমাদেরকে না জানিয়ে জমি অন্যত্র বিক্রয় করেন। আমি বলেছিলাম, তোমরা তো আগের টাকাই দাও নি, তোমাদের জানালে তো আমার ক্ষতি হতো। পরে হাজী মাসুদ ও তার ছেলে, ‘শালা মালাউন’ গালি দিয়ে আমাকে মারপিঠ করে আটকে রাখে। শেষে ৯৯৯’এ ফোন দিলে পুলিশ গিয়ে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
বিকাশ রঞ্জন সরকার বললেন, এই ঘটনায় আমি থানায় মামলা করলে, এমপি রতন পিন্টু চন্দ্র দে নামের গ্রামের আরেক ছেলেকে দিয়ে আমার নামে প্রতারণার মামলা করায়। জমি বিক্রয় করার কথা বলে গ্রামের জনৈক পিন্টু দে’র কাছ থেকে আমি তিন লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছি বলে মামলায় দাবি করা হয়। গ্রামের বশির উদ্দিন নামের আরেকজনকে দিয়ে টাকা আত্মসাতের মামলা করায়। দুটি মামলাই মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এমপি’র প্রভাব খাটিয়ে পুলিশকে দিয়ে আমার মামলায়ও ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ানো হয়।

আমি ছাড়াও গ্রামের প্রদীপ কুমার তালুকদার টুটুলের বাড়িও দখলের চেষ্টা করেন রতন। রতনের চাচা মাফিক আলীকে দিয়ে প্রদীপ কুমার তালুকদার টুটুলকে অপদস্তও করা হয়।

ধর্মপাশা উপজেলার সেলবরস ইউনিয়নের মাটিকাটা গ্রামের বাসিন্দা মো. মতিউর রহমান বলেন, নিজের নামে করা স্কুলের খেলার মাঠের জন্য আমাদের জমি দখলে নেওয়া হয়। আমাদের পুকুর পাড়ের ও বাড়ির গাছ- কেটে নিয়েছে তার লোকজন। বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করেছে। মামলার ভয়ে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। এমপি ও তার লোকদের ভয়ে গ্রামের মানুষ এমন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে নি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। এরপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি শুরু করেন। পাশাপাশি সরকারি জমি ও এলাকার মানুষের সম্পত্তি লুটপাট করার নেশায় পায় তাকে।

বালু-পাথর উত্তোলন, কয়লা আমদানিকারক সমিতি, বিভিন্ন মার্কেট, বাজার, নানাজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করতেন তিনি। তার নামে ঢাকা, সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, নেত্রকোনা ও মোহনগঞ্জে একাধিক বাড়ি রয়েছে। শুলশান-১ এ ন্যাম ভবনে রয়েছে ফ্ল্যাট। নিজের গ্রাম ধর্মপাশায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করেছিলেন বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’। সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে জেলা পুলিশ লাইন্সের বিপরীতে কোটি টাকায় বাড়ি (‘পায়েল পিউ’) কিনেছেন তিনি। প্রবাসেও বিশেষ করে কানাডায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এমন আলোচনাও আছে তার এলাকায়। অথচ নির্বাচনী হলফনামায় অনেক কম মূল্য দেখিয়েছেন এসব বাড়ি ও এপার্টমেন্টের।

বর্তমানে তার গ্রামের বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’ ভাড়া দিয়েছেন বিদেশী কোম্পানী নরিনকো ইন্টারন্যাশনালের (এইচ, কে,জিই সোলার পাওয়ার প্লান্ট) কাছে। গেল সপ্তাহে সেখানে সংবাদ সংগ্রহে করতে গেলে বাধার মুখে পড়তে হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। গেটে মুঠোফোনে কোম্পানির প্রতিনিধি পরিচয়ে তানভির নামে একজন গণমাধ্যমকর্মীদের অপেক্ষা করতে বলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর মো. ফজলুর রহিম নামে একজন এসে ভেতর ছবি তুলার সুযোগ করে দেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ফজলুর রহিম রতনের আত্মীয়। নরিনকো ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে রতনের ব্যবসায়িক যোগাযোগ রক্ষা করেন ফজলুর রহমান।

অভিযোগ রয়েছে, কেবল বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’ নয় সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করে নিজের নামে করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ। জমির প্রকৃত মালিককে উচ্ছেদ করতে সংগঠনের লোক ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানোর অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও নির্বাচনী এলাকার ৪৭ টি এলাকায় আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ডে নিরীহদের ও সরকারি জমি দখল করে অফিস করলেও ওখানে রতনের অনুসারি ব্যবসায়ী সি-িকেটের সদস্য ছাড়া অন্য আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা বসতেন না। আওয়ামী লীগের পুরোনো কর্মীরা বসতে বিব্রত হতেন, তারা সেখানে যেতেন না। পাঁচ আগস্টের পরে এসব অফিসে তালা দিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও সরকারি জমিতে করা কয়েকটি অফিস স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন।

নির্বাচনী হলফনামায়ও রতন মিথ্যা তথ্য দেন
বার বারই তিনি সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হফলনামায় দেখানো আয় থেকে পরের তিনটি হলফনামায় অনেক কম আয় দেখিয়েছেন। তবে নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামা থেকে পরের তিনটি হলফনামায় ক্রমান্বয়ে বেড়েছে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ। এরমধ্যে স্থাবর সম্পদ বেড়েছে ২ গুণ ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৩ গুণেরও উপরে। তাঁর নিজের দেখানো আয় ও স্থাবর সম্পদ বেড়ে যাবার তথ্যেও আছে গড়মিল।

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় বাৎসরিক আয় উল্লেখ করেছেন ২ কোটি, ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪৬ টাকা, ২০১৩ সালে ২৯ লাখ ৫০ হাজার ২৬৮ টাকা, ২০১৮ সালে ৩০ লাখ ২ হাজার ৬৮৫ টাকা ও ২০২৩ সালে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৪৯ হাজার ৭৩৪ টাকা।

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় স্থাবর সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ৭৩ লাখ ৪০ হাজার ২৫৮ টাকা, ২০১৩ সালে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩০২ টাকা, ২০১৮ সালে ৩ কোটি ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৮ টাকা ও ২০২৩ সালে ৩ কোটি ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ৮৯১ টাকা।

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ১ কোটি ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৪৮৯ টাকা, ২০১৩ সালে ১ কোটি ৫৪ লাখ ১৫ হাজার ৯১০ টাকা, ২০১৮ সালে ২ কোটি ২৭ হাজার ৮৪ হাজার ৮২৭ টাকা ও ২০২৩ সালে ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৯৩০ টাকা।

২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে তিন বার এমপি হলেও ২০২৩ সালে দলের মনোনয়ন পাননি এই সাবেক এমপি। পরে এই আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. রনজিত চন্দ্র সরকার।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা দখল করে বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজের জন্য ৪৭ টি অফিস নির্মাণ করেছেন। নিজের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন। গ্রামের বাড়ি করেছেন ক্ষমতার জোরে অন্যের জমি দখল করে। তাহিরপুরের তিন শুল্কস্টেশন ও বালুপাথর মহাল যাদুকাটায় চাঁদাবাজি করেছেন।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ছিলেন একজন সাধারণ কর্মচারী। দুর্নীতির অভিযোগে সেখান থেকে চাকরিচ্যুতও হয়েছিলেন তিনি। দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। তবে ভাগ্য বদলাতে বেশি সময় লাগেনি। সুনামগঞ্জ-১ (ধর্মপাশা-জামালগঞ্জ-তাহিরপুর) আসনে এমপি হয়েই খুলে গেছে তার ভাগ্য। এ পদটিকে আলাদিনের চেরাগের মতো ব্যবহার করেছেন তিনি। সামান্য কর্মচারী থেকে অল্পদিনেই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এমপি ও তার পরিবারের সদস্যরা।

সাবেক এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যুবলীগ নেতা বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমমের সম্পর্ক নিয়ে বছর দুয়েক আগে গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ ছাপা হয়। অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো কারবার, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রতনকে। এক পর্যায়ে তাঁর বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। শুধু তাই নয় তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

পরিবর্তিত রাজনৈতিক এসব অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন মহলের আলোচনা ওঠায় মঙ্গলবার দুপুরে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের মল্লিকপুর এলাকায় থাকা মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি ‘স্পর্শ স্পন্দন ড্রিম হাউজে’ যান দুদকের অনুসন্ধান দলের কর্মকর্তা। সঙ্গে সুনামগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীরাও ছিলেন। তাঁরা বাড়িটি পরিমাপ করেন। বাড়িটি পরিমাপ ও মোয়াজ্জেম হোসেনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) কয়েকজন সদস্যও সেখানে ছিলেন। সোমবার একইভাবে ধর্মপাশা উপজেলার নওধার গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেনের বিলাস বহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলায়’ গিয়ে সেটির পরিমাপ করা হয়।

অনুসন্ধান দলের সদস্য দুদকের সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান ভুঁইয়া জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ ছিল। ৫ আগস্টের পর আরও কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের পরিচালক আবদুল মাজেদের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল তাঁর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছেন। এই দলের বাকি দুই সদস্য হলেন, দুদকের অতিরিক্ত পরিচালক গুলশান আনোয়ার ও উপসহকারী পরিচালক এলমান আহমেদ।

মাহমুদুল হাসান ভুঁইয়া জানান, এর আগেও মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অভিযোগে অনুসন্ধান হয়েছে। সেগুলোর তথ্য দুদকে আছে। এখন সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনো, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় অনুসন্ধান চলছে। তাঁরা সব জায়গায় যাবেন। অনুসন্ধান শেষে দুদকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেবেন।

মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ২০০৮ সালে প্রথম নৌকা প্রতীক নিয়ে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালেও একইভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোননয় না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন।

তার দেওয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১০ বছরে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে বহুগুণ। ওই হিসাবের বাইরে আদতে তার সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি।

সাবেক সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে (নম্বর ০১৭১৫০২০৮৩৩, ছয় জানুয়ারি বেলা দুইটা ৪৮ মিনিটে) ফোন দিলে তিনি এসব বিষয়ের উত্তর এড়িয়ে বললেন, ‘এখন কতোজনে কতো কথা বলবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। দেশেই আছি, আমরা মাঠে নামলে সবাই দৌঁড়ে পালাবে।’

তিনি বলেন, ‘যখন আপনি ভালো থাকবেন তখন খারাপ- মন্দ কাজ করলেও লোকে ভালো বলবে। আর যখন খারাপ থাকবেন, তখন ভালো কাজটাও সবাই মন্দ বলবে। আমাদের বাঙালির কালচারটাই এরকম। অফিস করেছি, দলের জন্য কাজ করেছি এটা দোষের কিছু নয়। অনেকেরই ভালো লেগেছে, অনেকের লাগে নাই। ডিসি’র খতিয়ানের অনেক জায়গা লিজ নিয়ে অফিস করা হয়েছে। এটাও দোষের কিছু নয়। এখন অফিস অন্যরা দখলে নিয়েছে, আবার যখন মাঠে আওয়ামী লীগ আসবে, সব দৌঁড়াইয়া পালাবে। এটাই বাস্তবতা। বিএনপির নেতারা আমার বিরুদ্ধে বলবেই, কিছু করার নেই। আগে কেনো তারা এসব বলে নাই। আমাদের দলের লোকও কিছু আছে। যারা এসব সমালোচনা করছে। ২০০৮ সাল থেকে সমালোচনা শুরু হয়েছে, চলছেই। এগুলো নিয়ে কথা বলার পক্ষে নই আমি। সমালোচকরা সমালোচনা করবে, আপনার কাজ আপনি করবেন। দেখবেন আপনি এগিয়ে যাবেন।