গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীর মনোবল এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ফিরে আসেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক প্রভাবে পুলিশ ছাত্র-জনতার আন্দোলনসহ পতিত সরকারের বিরোধীদের দমনে সহিংস ভূমিকা রেখেছে; প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে, তার জন্য অনুশোচনা ও দুঃখ প্রকাশ করে যাচ্ছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। আন্দোলন দমনে পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের ফলে পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। এই আস্থাহীনতা থেকে খোদ পুলিশেরও মনোবল কমেছে। যার প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলায়। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। বিপ্লবোত্তর সরকার নিয়ে দেশে-বিদেশে যেসব ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তার মোকাবিলায় পুলিশ বাহিনীকে সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা থেকে শুরু করে থানা পুলিশ ও বিশেষায়িত পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত। পদোন্নতি বদলি ও পদায়ন নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের নানা ধরনের হতাশা থাকায় তারা যথোপযুক্ত ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. মতিউর রহমান শেখ কালবেলাকে বলেন, ‘পেশাদারিত্ব বজায় রেখে পুলিশ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারলে অনেক বিষয় সহজ হয়ে যায়। আমরা চাই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত পুলিশ বাহিনী। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের রয়েছে উজ্জ্বল অতীত। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে আমরা কাজ করতে চাই। করোনাসহ অতীতে বড় বিপর্যয় পুলিশ ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করেছে। পুলিশকেও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। পুলিশের মনোবল সুদৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসিকভাবে উজ্জীবিত করতে হবে। পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের কাজটি করে যাবে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ একটি ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে পুলিশকে এমন কঠিন অবস্থায় আর কখনো পড়তে হয়নি। ৫ আগস্টের আগে পুলিশ হয়ে পড়েছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের ‘লাঠিয়াল’। ফলে পুলিশকে জনরোষের শিকার হতে হয়েছে। পুলিশের নেতৃত্বস্তর ভেঙে পড়ে এবং জনআস্থা থেকে ছিটকে পড়ে। এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পুলিশকে সুসংগঠিত করা, তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনা ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। আমরা সেজন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। পুলিশ যাতে আর কখনো জনবিরোধী অবস্থানে ফিরে যেতে না পারে, সেই লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। উদ্যম, আগ্রহ আর নিষ্ঠা নিয়ে আমরা পুলিশকে সংগঠিত করছি।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনা পুলিশের জন্য লজ্জার। এ লজ্জাজনক ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। মানুষকে সেবা দিতে হবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে। আর এই সেবা দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, এখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজেদের পুলিশ অফিসার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করছি। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এরূপ পুলিশ এ দেশের মানুষ দেখতে চাননি। আন্দোলনে হাজার ছাত্র-জনতার মৃত্যু দুঃখের গাথা রচনা করেছে। আমরা স্বাধীন দেশের পুলিশ। কী কারণে মানুষের এত ক্ষোভ পুলিশের ওপরে? জুলাই-আগস্টের ঘটনা আমাদের সামাজিকভাবে অনেক নিগৃহীত করেছে। পুলিশ এখনো এক ধরনের মানসিক ট্রমার মধ্যে রয়েছে। এই ট্রমা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। বের হয়ে আসার জন্য একটাই উপায়, নিজেদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষকে সেবা দিতে হবে। সেবা দেওয়ার মাধ্যমেই একমাত্র পুলিশের হারানো ইমেজ বা গৌরবকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবো।
শেখ সাজ্জাত আলী বলেন, ৫ আগস্টের ৭২ ঘণ্টা আগেও যদি তখনকার নেতৃত্বে থাকা পুলিশ অফিসাররা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে অনেকের জীবন রক্ষা হতো। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরও জীবন রক্ষা হতো। কিন্তু এরূপ সিদ্ধান্ত তখন নেওয়া হয়নি। পুলিশে গত ১৫ বছরে যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তারা কি ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা কি কর্মকাণ্ড করলেন যে, এ দেশের মানুষ পুলিশের প্রতি এত ত্যক্তবিরক্ত হলো। যার বহিঃপ্রকাশ ৪৪ পুলিশ সদস্যকে জীবন দিতে হলো, শত শত সহকর্মীকে নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে হলো। সঙ্গে পুলিশের থানা, ফাঁড়ি, অস্ত্র লুট হয়ে গেল। পুলিশের যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না বা নিতে পেরেছেন কি না, সেই বিচারের বিবেচনা আপনাদের হাতে ছেড়ে দিলাম।
সবার আগে পুলিশকে উজ্জীবিত করা জরুরি মনে করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে বিপদে ফেলতে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করাটাই পুলিশ ও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। সেজন্য পুলিশকে মানসিকভাবে চাঙ্গা হওয়া জরুরি।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, ‘৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাগুলো পর্যাপ্ত নয়। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশও আতঙ্ক ও এক ধরনের মানসিক ট্রামার মধ্যে রয়েছে। পুলিশের আতঙ্ক দূর করতে পুলিশের সার্ভিল্যান্স বাড়াতে হবে।
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ের ভূমিকার জন্য পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনাকে আমি অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখি। কারণ পুলিশ মনে করে ওই সময় তাদের বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। এজন্য ক্ষমা চাওয়া যৌক্তিক এবং সাধারণ মানুষ সেটাকে ভালোভাবে নিচ্ছে। কারণ পুলিশ ছাড়া দেশ চলবে না। এই ক্ষমা চাওয়া ও দুঃখ প্রকাশ করা পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াবে এবং কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মনোবল সুদৃঢ় হবে। মানুষ পুলিশের ওই সময়কার বিতর্কিত ভূমিকাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। পাশাপাশি যারা অন্যায় ও অন্যায্য বল প্রয়োগসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল, তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত।’