হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় চলমান বাঁধ ও ক্লোজার নির্মাণে অনিময় নিয়ে ‘ক্লোজার কমলেও বরাদ্দ কমে নি’ দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরের প্রথম পাতায় গেল ২৪ ডিসেম্বর এই সংবাদ প্রকাশের পর রবিবার সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া ব্যাখ্যা চেয়েছেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরের সংবাদ উদ্ধৃত করে জেলা প্রশাসক জানতে চান, গেল বছর হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ করার সময় ক্লোজার ছিল ১৬৯ টি, প্রকল্প ছিল ৭৩৪ টি। এবার প্রকল্প হয়েছে ৬৭৫ টি, ক্লোজারও কমেছে। সবমিলিয়ে ক্লোজার চিহৃিত করা হয়েছে ১০৫ টি। গেল বছর বাঁধের কাজের চূড়ান্ত বিল হয়েছিল ১০২ কোটি টাকা। এবছর ইস্টিমিটিটেড কস্ট পাঠানো হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই বছর কাজ শেষে ২৩ কোটি টাকা বেশি বিল লাগবে। এটা কেন, জানতে চান জেলা প্রশাসক।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বললেন, ২০২৩ এবং ২০২৪ অর্থ বছরের ইস্টিমেইটেড কষ্ট নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে। এই বিষয়ে সরেজমিনে হাওররক্ষায় পুরোনো বাঁধ আছে, দেখা গেছে এমন কথাও উল্লেখ আছে সংবাদে, তবুও ব্যয় কেন বাড়লো, এটিও জানতে চেয়েছেন জেলা প্রশাসক।
শেষে আমাদের পক্ষ থেকে প্রকল্পের খরচ বাড়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আমরা বলেছি গেল বছর ছোট ছোট ভাঙনকে বড় ক্লোজার হিসেবে দেখানো হয়েছিল। সেজন্য সংখ্যা বেশি হয়েছিল। এবার ভাঙন বড়। এজন্য ব্যয় বেড়েছে। এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক বলেছেন, এই বিষয়ে পরে কথা বলবেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদারের কাছে এই প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিল, গেল বছরও তো আপনারাই দায়িত্বে ছিলেন, তাহলে ছোট ভাঙনকে গত বছর বড় ভাঙন দেখিয়ে বেশি ভাঙন দেখানো হলো কেন?
নির্বাহী প্রকৌশলী উত্তরে বললেন, গেল বছর উপ—সহকারী প্রকৌশলীরা নতুন এসে ছিলেন বুঝতে পারেন নি। অন্যদিকে, জামালগঞ্জের উপ—সহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জনি জানালেন, তিনি গেল দুই বছর বাঁধের কাজে যুক্ত ছিলেন। অন্যান্য উপজেলাতেও একেবারে নতুন কেউ নেই। কেউ দুই বছর, কেউ তিন বছর হয়, একেক উপজেলায় কাজ করছেন।
প্রসঙ্গত, হাওর রক্ষা বাঁধের জামালগঞ্জের একটি এলাকায় সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গছে, গতবারের তুলনায় এ বছর ক্লোজার (বিপজ্জনক ভাঙ্গা) কমেছে, পুরোনো মাটিতে অক্ষত আছে অনেক বাঁধ। তারপরও হাওর রক্ষা বাঁধে ইস্টিমিটিটেড কস্ট (প্রাক্কলিত মূল্য) কমছে না। বরং সবকিছু চলছে পুরোনো আদলেই। খরচ আরও বেশি লাগবে দেখানো হচ্ছে এবার।
উপজেলার হালি, শনি ও মহালিয়া হাওর ঘুরে দেখা যায়, এ বছর বাঁধ সংস্কার ও মেরামতে যে পরিমাণ বরাদ্দ হয়েছে, তাতে লুটপাটের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। হালি হাওরের বদরপুর থেকে হাওড়িয়া আলীপুর অংশের অধিকাংশ স্থানে পুরোনো মাটি রয়ে গেছে। ঘনিয়ার বিলসংলগ্ন বাঁধে বরাবরের মতো এবছরও একটি বড় ভাঙ্গন থাকলেও হাওড়িয়া আলীপুর স্কুলের ধারেকাছে গেল বছরের বড় ভাঙ্গনটি এই বছর নেই। শনির হাওরের নান্টুখালি বাঁধের পুঁটিচূড়া বিলসংলগ্ন অংশে একটি বড় ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরও তার আশেপাশে এমন একটি ভাঙ্গন ছিল। তবে এই হাওরের বিপজ্জনক ভাঙ্গন লালুর গোয়ালা (রাজধরপুর গ্রামের বিপরীত পার) অক্ষত থাকলেও স্লুইচ গেটসংলগ্ন নতুন অংশে ক্লোজারের সৃষ্টি হয়েছে। একই হাওরের জামালগঞ্জ অংশের অন্য বাঁধগুলো অনেকটা অক্ষত আছে। বেহেলি বাজারের উত্তরপাড়ের শনির হাওর অংশে প্রতিবছর বাঁধ হয়, সেখানে ছোটখাটো একটি ভাঙ্গন আছে।
বেহেলী বাজার থেকে বদরপুরমুখী কছমার হাওর অংশে একটি ক্লোজার আছে। এখানে প্রতি বছরই বাঁধ হয় এবং ছোট—বড় একটি ক্লোজারও থাকে। আগেও ছিল।
অপরদিকে, হালি হাওরের মামুদপুর গ্রামের সন্নিকটে বাঁধটি (পানি নিষ্কাশন ও প্রবেশের সুবিধার্থে কেটে দেওয়া) পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) মাধ্যমে প্রতি বছর সংস্কার করা হয়। এ বছর এখানে ভাঙ্গন ছোট। এজন্য বেশি মাটির প্রয়োজন হবে না। মামুদপুরের সেই ভাঙ্গা থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত বাঁধের অনেকাংশে পুরোনো মাটির দেখা মিলেছে। অপরপাড়স্থ মহালিয়া হাওরের হিজলা গ্রামের উত্তরাংশে বরাবরের মতো এ বছরও ক্লোজার আছে। তবে এ হাওরের ঝালোখালি অংশে (মদনাকান্দি গ্রামের পশ্চিমে) গত বছর অতি ঝুঁকিপূর্ণ যে ক্লোজার ছিল, এ বছর সেটি নেই। এছাড়া এখানকার অন্য বাঁধগুলো স্থায়ী বাঁধের মত হয়ে আছে।
এদিকে, মদনাকান্দি থেকে আছানপুর হালি হাওর অংশে কোন ভাঙ্গন নেই। ২০২২ সালে আছানপুর প্রাইমারি স্কুলের সম্মুখস্থলের বাঁধ ভেঙ্গে হাওর ডুবির যে ঘটনা ঘটেছিল এ বছর সেই বাঁধ পুরোপুরি অক্ষত আছে। আছানপুর থেকে সুন্দরপুর—কালীবাড়ি হয়ে উলুকান্দি—যতীন্দ্রপুরমুখী ডাকাতখালি বাঁধ পর্যন্ত কোন ভাঙ্গনের দেখা মেলে নি। তবে উলুকান্দি—যতীন্দ্রপুর গ্রামের আশপাশে গত বছরের ন্যায় এ বছরও ছোটখাটো তিনটি ভাঙ্গন রয়েছে। এছাড়া জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের সুরমা নদীঘেঁষা পুরোনো ভাঙ্গনটি এ বছরও আছে। সবকিছু মিলে ২০২৩—২৪ অর্থবছরে মেরামতকৃত ছোট—বড় ভাঙ্গনের তুলনায় এ বছর ক্লোজারের সংখ্যা কমলেও বরাদ্দ কমে নি।